করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের জনগনের শরীর?

--

ডা. ফৌজিয়া খানম এবং আব্দুল জব্বার তপু

‘করোনা ভাইরাস’ শব্দটি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ। সারা বিশ্বের মানুষের আতংকের নাম করোনা ভাইরাস। ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটির নাম দেয় ‘২০১৯-এনসিওভি’। ভাইরাসটি ‘কোভিড-১৯’ বা ‘নভেল করোনা’ নামেও পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৮ই মার্চ পর্যন্ত ১৯৯ দেশের মোট ৬০৭,৩১০ জন মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৭,৬৭৭ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সংখ্যাগুলো দৈনিক জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) কর্তৃক ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ই মার্চ প্রথমবারের মত বাংলাদেশে ৩ জন করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয়। ২৮শে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৮ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার মধ্যে মারা গিয়েছেন ৫ জন।

২০২০ সালের ২৪শে জানুয়ারী আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেট কর্তৃক ‘করোনা আক্রান্ত্ রোগীদের ক্লিনিক্যাল ফিচার /ইতিহাস’ বিষয়ক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যেখানে ৪১ জন করোনা রোগীর রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২০ শতাংশের ডায়বেটিস, ১৫ শতাংশের হাইপার-টেনশন, ১৫ শতাংশ রোগীর হৃদরোগ ও ৩২ শতাংশ অন্য কোন মৌলিক রোগে আক্রান্ত ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনায় মৃত্যুহার ৩.৪ শতাংশ। চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর ৪৪৬৭২ রোগীর উপর করা গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনা আক্রান্তদের সার্বিক মৃত্যুহার ছিল ২.৩ শতাংশ। এবং যারা আগে থেকেই অন্য কোন দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যে মৃত্যুহার সবেচেয়ে বেশি ছিল । যেমন, কার্ডিওভাস্কুলার রোগীদের মধ্যে ১০.৫ শতাংশ, ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে ৭.৩ শতাংশ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগীদের মধ্যে ৬.৩ শতাংশ, উচ্চরক্তচাপের রোগীদের মধ্যে ৬% এবং ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৫.৬ শতাংশ মানুষ মারা যান। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, যারা দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত তারাই সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। আইইডিসিআরের ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে পাঁচজন মারা গেছে তাদের মধ্যে দুইজন ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন, দুই জন জটিল রোগে (রোগের নাম উল্লেখ করা হয়নি) দীর্ঘ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং বাকি একজন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।

বাংলাদেশে বেশ কিছুকাল সময় ধরেই সংক্রামক রোগ থেকে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই কোন না কোন অসংক্রামক রোগের কারণে হয়। ২০১৭ সালে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) কর্তৃক পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি চার জনের একজন উচ্চ রক্তচাপ, প্রতি ১০ জনের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং অর্ধেকের বেশি উচ্চরক্তচাপের রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। দীর্ঘমেয়াদী রোগগুলো মূলত চারটা কারণে বেশি হয়; শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান।

বাংলাদেশের অসংক্রামক রোগগুলোর দ্রুত বৃদ্ধি ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারীদের রোগের ইতিহাস থেকে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই করোনাভাইরাস বা ভাইরাস জাতীয় রোগের মোকাবেলার জন্য কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের মানুষের শরীর? কি থাকে এদেশের মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকায়? এদেশের জনগন সারাদিনে কতটুকু শারীরিক পরিশ্রম করে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের প্রতিদিন পাঁচ সার্ভিং (১ সার্ভিং সমান ৮০ গ্রাম) সবজী ও ফলমুল খাওয়া প্রয়োজন। মাঝারি এক বাটি রান্না সবজী মানে দুই সার্ভিং ও একটি মাঝারি আকারের কলা বা আপেল মানে এক সার্ভিং। অর্থাৎ সারাদিনে মাঝারি এক বাটি রান্না সবজী, দু্ইটি মাঝারি কলা ও একটি আপেল খেলে বা দুই বাটি রান্না সবজী ও একটি কলা/আপেল খেলে সারাদিনের পাঁচ সার্ভিং সবজী ও ফল খাওয়া হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে এটি প্রতিদিনের হিসাব। একজন মানুষের সারাদিনে পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিৎ নয়। অতিরিক্ত লবণ শরীরে জমা অতিরিক্ত পানি রক্তনালীতে ঢুকিয়ে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় যা স্ট্রোক, হৃদরোগ ও কিডনি রোগের ঝুকি বাড়ায়। একজন মানুষের প্রতিদিন ১২ চা চামচের বেশি চিনি খাওয়া ঠিক না। অধিক চিনি শরীরের স্থুলতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলেও হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করা উচিৎ। শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে আছে হাটা, ঘর-বাডি মোছা, জগিং করা, খেলাধুলা করা, সাইকেল চালানো, কৃষি কাজ করা, ভারোত্তলন করা প্রভৃতি।

২০১৮ সালে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) কর্তৃক বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্ক লোকদের দৈনিক ফল ও সবজী খাওয়ার হার যথাক্রমে ০.৪ ও ২.৩ সার্ভিং। দিনে পাঁচ সার্ভিংয়ের সমপরিমাণ ফল ও সবজী খায় মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ। প্রায় ৪৮ শতাংশ মানুষ খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ খায়। প্রায় ২৯ শতাংশ লোক সপ্তাহে ১৫০ মিনিটের কম শারীরিক পরিশ্রম করে। প্রায় ২৩ শতাংশ লোক ধুমপান করে। যাদের মধ্যে পুরুষ প্রায় ৪৯ শতাংশ।

দৈনন্দিন অস্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা ও অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম আমাদের দেশে অসংক্রামক রোগগুলো বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ। অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। করোনাসহ ভাইরাস জাতীয় রোগগুলোতে কয়েকটি উপসর্গ (জ্বর, সর্দী, শ্বাসকষ্ট, বমি, পাতলা পায়খানা, খাবারে অরুচী প্রভৃতি) এক সাথে এসে অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা ও কর্মকাণ্ড পরিবর্তন করতে হবে। খাবার তালিকায় যেমন সবজী, ফল, মাছ-মাংস পরিমান অনুযায়ী রাখতে হবে তেমনি শারিরীক পরিশ্রম বাড়াতে হবে। অন্যথায় করোনার মত হঠাৎ করে আবির্ভূত হওয়া ভাইরাস কেড়ে নিয়ে যাবে হাজারো প্রাণ।

আব্দুল জব্বার তপু, সিনিয়র ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. ফৌজিয়া খানম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

--

--

BRAC James P Grant School of Public Health

BRAC JPG School of Public Health, Bangladesh tackles global health challenges affecting disadvantaged communities through Education Training Research & Advocacy