কোয়ারান্টাইন জীবনঃ আলো ও অন্ধকারের অবোলকন

--

মোঃ ইমরান হোসেন

২০২০ — পৃথিবীর বাকি সবার মত আমার ও বছর টা শুরু হহয়েছিল নতুন কিছুর আশায় এবং নতুন কিছু স্বপ্ন নিয়ে। সেইভাবেই চলছিল সবকিছু | সদ্য জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরিতে যোগদান করা, নিজের কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পরা এবং আরো অনেক কিছু। এরই মধ্যে শুনতে পেলাম চীনের উহান শহরে করোনা নামক এক প্রানঘাতি ভাইরাস এর প্রকোপ দেখা দিয়েছে | এরপর থেকে দিন দিন এই ভাইরাস সারা পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়ল। পত্র-পত্রিকা, সোস্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন সবকিছুতেই করোনা সংক্রান্ত খবরে সয়লাভ। প্রথমদিকে পুরো বিশ্ব বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে না দেখলেও চীনের পর ভাইরাসটি যখন ইতালি, ইরান এবং পৃথিবীর অনান্য দেশে মারাত্নক আকারে ছড়িয়ে পড়ল তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি রুপে ঘোষণা করল। মুলত তারপরই বিশ্ববাসী নড়েচড়ে বসল। সব দেশই আশঙ্কায় থাকল যেকোন সময় এই প্রানঘাতি ভাইরাস তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। তাই দেশে দেশে শুরু হল লকডাউন, সীমিত বিমান চলাচল, হোম কোরায়ন্টাইনের মত অনেক পদ্ধতি। বাংলাদেশও এর থেকে ভিন্ন নয়। মূলত এই ভাইরাসকে প্যানডেমিক ঘোষনার সাথে সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমি ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এ জয়েন করি। যে প্রতিষ্ঠানে ছাত্র হিসেবে দীর্ঘ এক বৎসর ছিলাম সেখানে যোগদান করে দিনগুলো ভালই যাচ্ছিল। করোনার শুরু থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেক সচেতন ছিল। আমাদের সবার মধ্যেই এই নিয়ে সব সময় আলোচনাও হত। আমাদের সব কাজকর্ম তার আপন গতিতেই চলছিল এবং আমরা আমাদের মত নিয়মিত অফিস করছিলাম। যখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে প্যান্ডেমিক হিসেবে ঘোষণা করল এবং পৃথিবী ব্যাপি করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকল তখনই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করলো। আমরা সবাই ভিত-সন্ত্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পরলাম — আমরা অফিসে কিভাবে যাব, কিভাবে নিজেদেরকে এই ভাইরাস থেকে দূরে রাখব। আবার এই মাসেই আমাদের গবেষণার জন্য ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে যাওয়ার কথা ছিল। ফলে আমরা চিন্তিত হয়ে পরলাম এই পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের কাজ শুরু করতে পারব কিনা। এরই মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা মূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছিল। এরমধ্যে ছিল হাত ধোয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ, বিভিন্ন সচেতনতামুলক কর্মসূচি, সেমিনার করা, নিয়মিত তাপমাত্রা পারিমাপ করা সহ আরও অনেক কিছু। তবুও আমাদের মনে একধরনের ভীতি কাজ করতে থাকল। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রথমে মাঠ পর্যায়ের সকল কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং তার কিছুদিন পরে ঘর থেকেই অফিসের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিষয়টা আমাদের কাছে নতুন হলেও আমরা সেই অনুযায়ী একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করি। আমরা নিজেরাও একটু স্বস্তি পেলাম।

বিগত ১৯ মার্চ থেকে ঘর থেকে অফিস করছি। বাসায় বসে আগে কখনও অফিসের কাজ করা হয়নি। বিষয়টি আমার কাছে একদমই নতুন। তাই আমি অনলাইনে একটু দেখলাম আসলে কিভাবে বাসায় বসে কাজ করা যায়। আমি সেই অনুযায়ীই প্ল্যান করলাম, আমার রুমটাকে কাজের উপযোগী করে সাজালাম। কিভাবে ভালোভাবে কাজ গুলো করা যায় তার জন্যও একটু ইন্টারনেট ঘাটলাম।বাসা থেকে কাজের প্রথম দিনের শুরুটা অফিসের মত সকালেই কাজ শুরু করলাম পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। কিন্তু কাজ করার সময় কিসের যেন শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করলাম। অনেকটা সময় কাজ করার পর অনুভব করলাম যে আমি অফিসে যে কর্মঊদ্দীপণা নিয়ে কাজ করি এখানে সেটা হচ্ছেনা। নিজেকে কেমন যেন দুর্বল লাগছে। বিষয়টি হয়তোবা নতুন পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে অথবা চারপাশের করোনা নিয়ে এতো কিছু এই নিয়ে ভাবার ফলে। দিন শেষে প্রতিদিনের টিম মিটিং এ নিজের কাজ বুজিয়ে দিয়ে প্রথম দিনের সমাপ্ত করলাম। দিনশেষে নিজের অজান্তেই একটি অনুভুতি হল আমি আমার অফিসকে, অফিসে আমার বসার ডেস্ককে অনেক বেশি মিস করছি।

দ্বিতীয় দিনের সকালের শুরুই হল অফিস থেকে পাঠানো একটি ইমেইল দেখে। জানতে পারলাম অফিস বিল্ডিং-এ একজন ব্যক্তি করনা পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে। তাই আমাদের অফিসের সবাইকে হোম কোয়ারাইন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। বিষয়টা জানার পর নিজের মধ্যে কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু এই ভয় বাঁধা কে অতিক্রম করেই আমাকে কাজ করতে হবে। আমি আমার পরিবারের কথা ভেবে অফিসের নির্দেশ মত আমার রুমে আমাকে আবদ্ধ করে ফেল্লাম। আমি আমার রুমে বসে বসে কাজের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারপর নিজের মনের অজান্তে এক করোনা ভীতি কাজ করতে থাকে। যতই চিন্তা বা সমস্যা হোক না কেন প্রতিদিনই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি। প্রতিদিন টিম মিটিং এ কাজের বিষয় ছাড়াও আমরা এইসব বিষয় নিয়েও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি এবং একে অপরকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করি। এরই মধ্যে আমার কাশির উপক্রম দেখা দেয় যা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান এবং এই সময় তা আমাকে মানসিক ভাবে অনেক দুর্বল করে ফেলে। আমার মনে নানা ধরনের খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। কি করব আর কোথায় যাব। চারদিকে শুধু খারাপ সংবাদ। কিন্ত আমি পরে নিজেকে সান্তনা দিলাম আমাকে এর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের টিমের সবাই সবাইকে উৎসাহ দেই যাতে কেউ না ভেঙ্গে পরে। এভাবেই চলতে থাকল সপ্তাহটা।

আজকে আমাদের দশমতম দিন হোম কোয়ারান্টাইনের, আরো থাকতে হবে ৪ দিন। এই দশদিনে মাঝেমাঝে নিজেকে অনেক অসহায় লেগেছে, নানা ধরনের দুশ্চিন্তা নিজের মনে বাসা বেধেছে। এখনও তা আছে নিজের মনের ভিতরে, কাজে মনোযোগী হতে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে, মনে হয়েছে স্রষ্টার করুণা ব্যতীত এই পৃথিবীতে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। চারদিকে শুধু করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর খবর। আমি পুরান ঢাকাতে থাকি।এখানকার মানুষজন তেমন সচেতন নয়। তারা কোন নিয়মনীতি না মেনেই রাস্তায় অবাধে চলাফেরা করছে, রাস্তায় যেখানে সেখানে থুতু ফেলছে। এ বিষয়গুলো আমাকে আতংকিত করে তুলে। দুশ্চিন্তা বিষয়টি কেন যেন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেল। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করল নানা বিষয় যেমনঃ পরিবারের সদস্যরা বাসায় আছে কিনা, কেউ বাইরে গেল কিনা, কাজের চাপ, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাধরনের নেতিবাচক খবর আর অফিসের কাজের চাপতো আছেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবসময় কোভিড-১৯ এর কি পরিস্থিতি জানার জন্য যখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি তখনই খারাপ খবর গুলো দেখে নিজের অজান্তেই আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবতে থাকি আমি অথবা আমার পরিবারের কোন সদস্য যদি এতে আক্রান্ত হয় তাহলে কি হবে, কোথায় যাব — এছাড়ও নানা ধরনের দুশ্চিন্তা। এইসব কারনে মাঝে মাঝেই কাজে মনোযোগ দিতে অনেক কষ্ট হয়। মনে মনে শুধু উপলব্ধি করি মানুষ কতটাই না আসহায়। তবুও কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি একসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বাদ দিয়ে দিলাম বিশেষ করে কাজের সময়, নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নিলাম। এইভাবে দুশ্চিন্তাগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করছি।

আমার কাছে মনে হয়েছে এই সময় মানুষ অনেকটা আতঙ্কগ্রস্থ থাকে। এই সমস্যা দূর করার জন্য প্রয়োজন একে অপরকে উৎসাহ দেয়া, বন্ধুবান্ধব এর সাথে যোগাযোগ রাখা এবং কথা বলা। যতটুকু সম্ভব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কম ব্যবহার করা, কারন নানা ধরনের নেতিবাচক বিষয় মানুষকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে ফেলে। হয়ত অতিশীঘ্রই আমরা এই দুরাবস্তা মোকাবেলা করে উঠব সেই আশাতেই আমাদের বেচে থাকা। পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই — নিজে মানসিক ভাবে শক্ত থাকুন, অপরকেও সাহায্য করুন। একটি কথা মনে রখবেন কোন অন্ধকারই চিরস্থায়ী নয়, আলো আসবেই, অপেক্ষা করুন।

মোঃ ইমরান হোসেন, রিসার্চ এসোসিয়েট, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

--

--

BRAC James P Grant School of Public Health

BRAC JPG School of Public Health, Bangladesh tackles global health challenges affecting disadvantaged communities through Education Training Research & Advocacy