New Normal অথবা নতুন স্বাভাবিক জীবন
তাসলিমা আক্তার
১৮ মার্চ ২০২০। সেদিন আমরা শেষ বারের মতো শরীরি উপস্থিতিতে অফিস করেছি। প্রথম কর্ম ঘন্টায় রোজদিনের রুটিন কাজ গুলো শুরু করার আগে মিডওয়াফারি ডিপার্টমেন্ট হেড এসে আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলেন, আজকের অফিস অন্য দশটা স্বাভাবিক দিনের মত হবেনা। আজ সারাদিন আমরা করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে প্রতিটি স্টাফকে বাসায় রেখে কিভাবে অফিসের কাজ করবো তার পরিকল্পনা করতে হবে। এটাই আজকের প্রায়োরিটি। আমরা ছোট ছোট করে বিভিন্ন সময়ে মিটিং করে আমাদের পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে নিলাম। দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা সাতটি একাডেমিক সাইটে পরিকল্পনাগুলো জানিয়ে অফিস শেষে বাসায় ফিরলাম। সমস্ত বাংলাদেশ লক ডাউনের আগে সেটাই আমার শেষ অফিস যাওয়া।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়টুকু পার করছি আমরা। সারা বিশ্ব থমকে গিয়েছে প্রকৃতি সৃষ্ট মহামারির তান্ডবে। শূন্য রাজপথ, শূন্য হয়ে গিয়েছে ব্যস্ত অফিস পাড়া, শূন্য পড়ে আছে অবকাশ যাপনের অতি মনোরম স্থানগুলো, ধর্মালয়গুলোও প্রায় জন শূন্য হয়ে গেছে। শান্ত হয়ে গেছে কর্মকোলাহলময় মানুষের জীবন। নব আবিস্কৃত এই ক্ষুদ্র, খালি চোখে দৃশ্যের অতীত এক ভাইরাসের ভয়ে গোটা বিশ্ব আতঙ্কের মধ্য দিয়ে পার করছে প্রতিটি প্রহর। এটা আমাদের জীবনে একবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা।
১৯ মার্চ তারিখ থেকে শুরু হলো আমার অন্য এক জীবন। পারিবারিক আর অফিসের মিশেলে একেবারে ভিন্ন ঘরানার জীবন। আমার স্বামী দু’বছরের একটা এসাইনমেন্টে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। আমাদের বাসার বর্তমান মোট সদস্য আমি, আমার এ লেভেল পড়ুয়া ছেলে আর আমার দশ বছর বয়সী কন্যা। এই তিনে মিলে আমরা আমাদের ঘরে থাকার নতুন জীবন শুরু করি। অফিস থেকে ফেরার সময় আমি দুটো গুরুত্বপূর্ণ লিফলেটের একটা করে প্রিন্ট কপি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। একটা লিফলেটের বিষয়বস্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রোধে করণীয়, অন্যটি ছিলো সঠিক নিয়মে হাত ধোয়া বিষয়ে। বাড়ি ফিরেই আমি সেই লিফলেট দুটো আমাদের এপার্ট্মেন্ট বিল্ডিঙয়ের লিফটের সামনের স্পেসে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এটা ছিলো আমার বাড়ির মানুষদেরকে সচেতন করার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আমরা দেশের আর সকলের মত বাড়ির ঠিকা গৃহকর্মীকে বৈতনিক ছুটি দিয়ে দিলাম। তারপর ঘরের তিন সদস্য মিলে মিটিঙয়ে বসলাম কিভাবে আমাদের আগামী দিনগুলোকে গৃহকর্মী ছাড়াই আমরা চালিয়ে নিতে পারি। আমরা খুব সতর্কতার সাথে কর্ম পরিকল্পনা বেঁছে বেঁছে ঠিক করলাম যাতে করে আমার অফিসের ডেলিভারেবলগুলো সঠিক সময়ে ডেলিভারি দেওয়া যায় আবার ঘর সংসারও ঠিক রাখা যায়। ঠিক হলো, মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে সবার বিছানা গুছাবে, তার পড়ার টেবিল গুছাবে আর বারান্দার গাছে পানি দেবে। মেয়ে এই দায়িত্ব পেয়ে বেশ একটা বড় বড় ভাব নিয়ে তার কাজ করতে শুরু করলো। প্রথম দিকে কাজে একটু এলোমেলো করলেও দু’তিন দিনে ঠিক সামলে নিয়ে সুন্দর ভাবে সে তার কাজগুলো করছে। উনিশ বছর বয়সী একটা ছেলেকে ঘড়ে আটকে রাখাও এক কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। কাঁচা বয়সের কারনে তার মন উচ্ছল আর স্বভাবতই বাইরে যাওয়ার প্রবণতা তাকে তাড়া করে ফিরে। যাই হোক, ঘরের কাজে সে নিজ থেকেই বেঁছে নিলো সাফ সুতরো করার কাজ, ডাস্টিং আর মপিং। পরে ছেলেকে আমি করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার দিকগুলো তুলে ধরা ডাব্লিও এইচ ও’র বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ, নিউজ লিংক এসব পড়তে দিলাম। ক’ দিনের মধ্যেই সে ঘরে থাকতে স্বচ্ছন্দ এবং আনন্দিত হলো। মজার বিষয়, এখন সে আমাকেও ঘরে থাকার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে। আমি স্বভাবতই রান্নার কাজটা বেঁছে নিলাম। কিন্তু কিভাবে সময় বাঁচানো যায় তাও ভাবতে বসলাম। আমি তিনদিনের রান্না একদিনে করে ফ্রিজ রেখে দেই আর প্রতিদিন প্রয়োজন মত খাবার গরম করে খাই। এভাবে সময় বাঁচলো আর “ওয়ার্ক ফ্রম হোম”ও সঠিকভাবে করা সম্ভব হলো।
করোনাভাইরাস সময়ে আমরা এই জীবনকে স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে শুরু করলাম। এটা একটা “New Normal” অথবা নতুন স্বাভাবিক জীবন ভেবে নিয়ে দিন কাটাতে শুরু করলাম। আমরা কাজ শেষ হয়ে গেলে নেটফ্লিক্সে ভালো কোন মুভি দেখি। বইমেলা থেকে সংগৃহীত বইয়ের শেলফে সাজিয়ে রাখা বইগুলো পড়ে শেষ করি। কখনো নতুন কোন রান্না এক্সপ্লোর করি। দেশে বিদেশে থাকা আত্মীয় বন্ধুদের সাথে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে যোগাযোগ রাখি। তাদের কথা শুনি আর নিজেদের কথা বলি। এই মন খারাপ করি আবার একটু পরেই হেসে গড়িয়ে পরি। এই দুর্দিনে আমরা আমাদের গৃহকর্মীর কথা ভুলে যাইনি। তার সাথে টেলিফোনে কথা বলি। এতে সে মোটিভেটেড হয়। একদিন সে জানালো তার ঘরের পাশে ঘরে এক ইতালি ফেরত লোক আছে। সে ফোনে কান্নাকাটি করছিলো। আমি তাকে স্বান্ত্বনা দিলাম আর ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিলাম। কালো জিরা আর থানকুনি পাতা করোনাভাইরাসের ওষুধ-এই বদ্ধমূল ধারনা থেকে আমি তাকে বের করে আনতে পারলাম অনেক বুঝিয়ে। বরং ঘরে থাকাই হচ্ছে ভাইরাস থেকে নিজে ভালো থাকা আর অন্যকে ভালো রাখার উপায়-এটা তাকে বুঝালাম। এভাবে আমরা দূরে থেকেও থাকলাম খুব কাছে।
তিন সপ্তাহের বেশী সময় পার হয়ে গিয়েছে আমরা মৃত্যু ব্যাধি করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি। এসময় আমার বেশ কিছু অভজার্ভেশন আমাকে নিয়ত ভাবায়। এর একটি হচ্ছে, হোম কোয়ারেন্টাইন সময়ে বাংলাদেশের নারীরা কিছু নিরব ও সরব সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
নারীকে আমরা স্বাধারণ হিসেবে দুইভাগে ভাগ করে ফেলি। যারা শুধুমাত্র গৃহকর্ম করে থাকে এবং যারা প্রাতিষ্ঠানিভাবে কাজ করে থাকে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সময়ে দুইধরনের নারীই ঘরে আছে। যারা প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করে তাঁরা আমার মত ঘরে বসে করছে অফিসের কাজকর্ম। আবার পরিবারের দেখভালও করছে। গৃহকর্মীহীন ঘরেও জীবন থেমে থাকেনা। নারী এখন ডাবল ট্রিপল দ্বায়িত্ব পালন করছে। ঘরের সমস্ত কাজ করছে আবার অফিসের ডেলিভারেবলগুলোও নিশ্চিত করছে। এতকিছু করতে গিয়ে নারী তাঁর নিজের জীবনকে করে তুলছে অসহনীয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ধারণ ক্ষমতার অত্যধিক কাজ করতে গিয়ে সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবে। ভেঙ্গে পরবে শরীরের ইমিউন সিস্টেম। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে।
গৃহহীন এবং ভাসমান নারীদের জীবনে এই সময়টি বিশেষভাবে ভয়ঙ্কর হতে পারে। যেহেতু এই নারীদের বিশেষ কোন সুরক্ষিত আশ্রয় নেই এবং রাস্তাঘাটও প্রায় জনশূন্য তাই তারা হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আরো বেশি বিপদাপন্ন। আমরা যতই হোম কোয়ারেন্টাইনে ঘরে আছি বা যতোদিন ধরে থাকবো ক্ষুধা কিন্তু আমাদের পিছু ছাড়েনা। তাই ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই যেতে হয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে। দেশে সিঙ্গেল মাদার কিংবা একা থাকা নারীদের সংখ্যা নেহাত কম না। নারী এখন নির্জন পথ পার হয়ে যাচ্ছে বাজারে, কিংবা ওষুধের দোকানে। নির্জন রাস্তায় যেনো কোন নারী হেনস্থার শিকার না হয় তার প্রতি আমাদেরকে একটু বেশী সজাগ থাকতে হবে। তাদের প্রতি জোরদার করা প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতার। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার নিজেরও রয়েছে এই সকল নারীর প্রতি দায়বদ্ধতা।
লক ডাউনে ঘরে থাকা সময়ে আমরা কিছু বিষয়ে আমরা সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারিঃ
বাড়ির বয়োবৃদ্ধদের করোনাভাইরাসের নিউজগুলো সারাক্ষণ দেখা থেকে বিরত করা। তা না হলে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকবেন। টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজে সারাক্ষণ বর্ধিত রোগী সংখ্যা, মৃত্যু সংখ্যাকে ক্রিকেট স্কোরের মত পর্যবেক্ষণ করা কোন কাজের কথা না। এই হিসেব রাখার জন্য প্রশিক্ষিত লোকজন রয়েছে। দায়িত্বটা তাদের কাছেই থাক। বয়োবৃদ্ধদেরকে বরং ভালো নাটক সিনেমা দেখা, পছন্দের বই-পত্র পড়া, ছোটদের সাথে আনন্দময় সময় কাটানোতে উৎসাহী করে তোলা যেতে পারে।
কিশোর কিশোরীদেরকে ঘরে থাকতে প্রলুব্ধ করতে হবে। কাঁচা বয়সের জন্য এরা ঘরে থাকতে যেন ছটফট না করে। ঘরের অন্যান্যদের সাথে মিলেমিশে সময় কাটানো, ঘরের দৈনন্দিন কাজগুলো সকলে ভাগাভাগি করে সেরে ফেলার ভাগটা তাদের দেয়া যেতে পারে। এতে করে তারা দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে এবং নিজেকে গুরুত্বপুর্ন ভাববে। শিশুদের সাথে মানসম্মত সময় কাটানো খুব জরুরী। তারা কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে পরুক। আর ছবি আঁকুক ইচ্ছে মত। নিজের পড়ার টেবিলটা সে নিজেই গুছিয়ে রাখুক।
আর হ্যা, সর্বোপরি নিজের দিকে ভালো খেয়াল রাখতে হবে। যদি নিজেই ভালো না থাকি তবে অন্যদেরকে কি করে ভালো রাখবো! সুস্থ থেকে নিজে বাঁচতে হবে আর পরিবারকেও বাঁচাতে হবে। বেশি অস্থির হওয়া যাবে না। প্রথম কয়েকদিনের বন্দী দশাতেই সব শক্তি খরচ করে ফেলা যাবে না। আমরা আসলে জানিনা কতদিন ধরে আমাদের এই নতুন স্বাভাবিক জীবন চলবে।
মানুষ সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। জগতের সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষের শক্তি অসীম। কালের আবর্তনে বিভিন্ন সময়ে অনেক নতুন অতুন মহামারিকে মানুষ ব্যর্থ করে দিয়েছে। এইবারও আমরা সফল হবোই। শুধু ধৈর্য, সাহস আর সচেতনতার সাথে সময়ের ব্যাপার মাত্র! মনে রাখা জরুরী, করোনাভাইরাস কখনো কারো ঘরে অতিথি হয়ে আসেনা যতক্ষন পর্যন্ত ঘরের বাইরে গিয়ে তাকে ডেকে না আনা হয়। তাই, অবশ্যই ঘরে থাকি-করোনা মুক্ত থাকি।
তাসলিমা আক্তার-অপারেশন্স ম্যানেজার, জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি