এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইনিং
আব্দুল জব্বার তপু
এটি একটি ইংরেজি প্রবাদ। ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে প্রবাদটির অর্থ হলো, প্রতিটি কঠিন বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির কিছু ভাল দিক থাকে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ করোনা ভাইরাস। যার ভয়াল থাবা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই কম-বেশি পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পন্ন দেশগুলোরও কংকাল বের করে ফেলেছে এই করোনা ভাইরাস। করোনার প্রকপে প্রতি মিনিটে বিশ্ব থেকে ঝরে পড়ছে ৫-৬ জন মানুষের জীবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুত্র মতে, ১৩ই এপ্রিল ‘২০ সকাল সাতটা পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে এক লক্ষ ছয় হাজারের বেশি মানুষ। আর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ লক্ষে ছুই ছুই করছে।
যে করোনা স্তব্ধ করে দিয়েছে সমগ্র্র পৃথিবীকে সেই করোনা পৃথিবীকে দিচ্ছেও অনেক কিছু। কিভাবে?
করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবীর ১০০ বছরের ইতিহাস কোনো মনুষ্য সমাজের ইতিহাস হতে পারেনা। ১০০ বছরে পৃথিবী বার বার দেখেছে মানুষের বর্বর রুপ। ক্ষমতা বা মতাদর্শ টিকিয়ে রাখার নামে সংঘঠিত হয়েছে দুটি বিশ্ব যুদ্ধ যাতে প্রাণ হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলো একের পর এক সামরিক বা অর্থনৈতিক হামলা চালিয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর উপর, পর্যাপ্ত খাবার মজুত থাকা সত্ত্বেও পৃথিবী দেখেছে দূর্ভিক্ষ। কৃত্রিম খাদ্য সংকটে যখন পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ না খেয়ে মরেছে ঠিক তখনই অন্যপ্রান্তে চলেছে খাবার অপচয়ের মহোৎসব। পাশাপাশি চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানী, হামলা-পাল্টা হামলা। ফলস্বরুপ পৃথিবী দেখেছে ওয়ান ইলেভেন, আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিয়ানমারসহ বহু দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের নিশংস হত্যা বা বাস্তুহারা জীবন। জন্ম হয়েছে শত শত জঙ্গী সংগঠন। নিরাপরাধ মানুষ মরেছে জঙ্গী হামলায়। বিগত ১০০ বছরে পৃথিবী যেমন দেখেছে আফ্রিকার কংকালসার মৃতপ্রায় শিশুর মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা শকুনের ছবি তেমনি দেখেছে সমুদ্র তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা সরণার্থী শিশুর নিথর দেহের ছবি।
উন্নত বিশ্বসহ প্রায় সকল দেশই তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ২০১৯ সালে আমেরিকার প্রস্তাবিত বাজেটে সামরিক খাতে প্রস্তাব করা হয় ৬৮৬ বিলিয়ন ডলার। চিকিৎসা খাতে যা ছিল মাত্র ৬৮.৪ বিলিয়ন ডলার। সামরিক দিক দিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশের থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে কোন দেশের সাথে যুদ্ধ করা তো দুরের কথা কোনো দেশের সাথে কখনো যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবও হয়নি। প্রায় সব সময়ই প্রতিবেশী দেশগুলোসহ সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। অথচ এই দেশেও সামরিক খাত চিকিৎসা খাতের থেকে বড়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বাজেটে সামরিক খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৩২ হাজার ১০১ কোটি টাকা যেখানে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে সম্পদ উপার্জনে মানুষ এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, বাবা ভুলে গিয়েছিল তার সন্তানকে বা সন্তান ভুলে গিয়েছিল তার বাবাকে, স্বামী ভুলে গিয়েছিল তার স্ত্রীকে বা স্ত্রী ভুলে গিয়েছিল তার স্বামীকে। সম্পর্কগুলো ছিল কৃত্রিম। মানুষ ভুলে গিয়েছিল ন্যায় –অন্যায় বা উচিত-অনুচিত জ্ঞান। চাই সম্পদ, তা যেকোন ভাবেই হোক। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, দূর্নীতিসহ এমন কোন অপকর্ম নাই যার মাধ্যমে মানুষ সম্পদ উপার্জন করেনি। অন্যের ভাল-মন্দ চিন্তা করার সময়টুকুও মানুষের ছিলনা। মানুষ ভুলে গিয়েছিল তার আসল পরিচয়। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল মনুষ্যবোধ।
করোনা পরবর্তী দুনিয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি বা বোমা বিস্ফরণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ব্যস্ত নিজের দেশের জনগনের সুরক্ষা নিয়ে। অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সময় কারোরই নেই। গত তিন মাসে বিশ্বের কোথাও শোনা যায়নি কোনো হামলা বা জঙ্গী হামলা। যেন সারাবিশ্বে অঘোষিত যুদ্ধ বিরতি চলছে। বাংলাদেশে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি নিত্য দিনের ঘটনা ছিল, বর্তমানে সেগুলো অনেকটা শুন্যের কোটায়। দেশের থানাগুলোতে যেখানে প্রতিদিন ৩০০ এর অধিক মামলা হতো সেখানে রাজধানীর রমনা থানায় পাঁচ দিনে মামলা হয়েছে দুইটি (সুত্র: ৩১শে মার্চ এনটিভি প্রচারিত প্রতিবেদন)।
করোনা উন্নত দেশগুলোসহ সকল দেশকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বড় বড় যুদ্ধ জাহাজ, আগ্নেয়াস্ত্র আর সুসজ্জিত সৈন্য বাহিনীর কোন দাম নাই। এগুলো সব পড়ে আছে। অথচ সবাই চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য হাহুতাশ করছে। পর্যাপ্ত ডাক্তার নাই, নার্স নাই, টেস্ট কিট নাই, পিপিই নাই, ভেন্টিলেটর নাই, হাসপাতালে জায়গা নাই, মর্গ ফাঁকা নাই। প্রায় সকল দেশে শুধু নাই আর নাই।
করোনা পরবর্তী দুনিয়া একে অপরকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। একদিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামর্থবান লোকেরা অন্যের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। কেউ সম্পদ দিয়ে আবার কেউ শ্রম দিয়ে অসহায় মানুষকে সহায়তা করছে। অন্যদিকে চিকিৎসা যোদ্ধারা (ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল কর্মী প্রভৃতি) নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত অসুস্থ মানুষদের সেবা দিচ্ছে। করোনা আক্রান্ত ডাক্তার নিজের হাতে স্যালাইন নিয়ে রোগীকে সেবা দিচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ দ্বায়িত্বশীল সকলেই যে যার জায়গাতে থেকে একে অপরের জন্য কাজ করছে।
করোনা বিশ্বের কোটি কোটি শিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের কর্মজীবী বাবা-মায়ের কোল। যে শিশু কোন দিন রাতের কৃত্রিম আলোতে বাবা-মাকে দেখতো বা কোন দিন না দেখেই ঘুমিয়ে যেত সে আজ দিনের আলোতে বাবা-মায়ের সাথে খেলছে, গাইছে, নাচছে। সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় যখন দেখি বাবা তার বাচ্চাকে জামা পরাচ্ছেন আর মা খাবার থালা হাতে করে খাওয়াচ্ছেন তখন অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হয়। এমন বাবা-মা তো সকল শিশুরা চায়। শৈশবে যদি বাবা-মাকে কাছে না পায় তাহলে তারা কিভাবে বুঝবে বাবা-মা কি?
করোনা যেন এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। যেখানে নেই কোনো সন্ত্রাস। অন্যায়ভাবে কোনো মা হারাচ্ছে না তার সন্তানকে বা সন্তানকে হারাচ্ছেনা তার মাকে। যে পৃথিবী মানবিক পৃথিবী। যে পৃথিবীতে মানুষ একে অপরের জন্য কাজ করছে। পৃথিবী হয়তো একদিন করোনা মুক্ত হবে। তবে করোনার এই শিক্ষাগুলো যেন বেঁচে থাকে, চিরকাল।
আব্দুল জব্বার তপু, সিনিয়র ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।