কোভিড-১৯ মহামারীতে নিম্ন আয়ের ঘনবসতি এলাকায় সহায়তা কার্যক্রম: ARISE কমিউনিটি গবেষকদের অভিজ্ঞতা

By সমদ্দার টুম্পা, জীবন আহম্মেদ জুম্মন, বিল্লাল হোসেন, আফসানা ইয়েমিন

২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে সমগ্র বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়তে শুরু করে। করোনার সংক্রমণ রোধ করার জন্য ২৯ মার্চ প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে সরকার সারাদেশে জনসমাগম ও যানবাহনের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এভাবে লকডাউন প্রয়োগের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ কিছুটা রোধ করা গেলেও, দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসরত অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয় শ্রেণীভুক্ত । ২০২০ সালের দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের পর এ বছর পুনরায় আরোপিত দ্বিতীয় লকডাউনের কারণে বস্তিতে বসবাসরত শ্রমজীবী মানুষের উপার্জন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তারা মানবেতর জীবন যাপন করতেবাধ্য হচ্ছে।

ARISE বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের মধ্যেও উল্লেখিত এলাকাগুলোতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাদের গবেষণাধর্মী কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। গবেষণা প্রকল্পে এই এলাকাগুলো থেকে মোট ৬ জন (৩ টি এলাকা থেকে ২ জন করে) তরুণ-তরুণীকে কমিউনিটি গবেষক হিসেবে কাজ করছে। লকডাউনের সময়ে কমিউনিটি গবেষকরা শুধুমাত্র গবেষণাধর্মী কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় করোনার সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিরলসভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে। কমিউনিটি গবেষকদের মধ্যে অধিকাংশই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছে এবং তাদের সবারই বিভিন্ন এনজিও এর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৩ টি এলাকার কমিউনিটি গবেষকরা দ্বিতীয় লকডাউনের সময় কোভিড রেসপন্স কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

নামা শ্যামপুর

নামা শ্যামপুর বস্তিতে বসবাসরত টুম্পা ARISE বাংলাদেশের একজন কমিউনিটি গবেষক এবং ব্র্যাক আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউডিপি) একজন কমিউনিটি অর্গানাইজার। দ্বিতীয় লকডাউনের সময় বস্তির মানুষদের মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ARISE রেস্পন্সিভ ফান্ডের সহায়তায় ব্রাক ইউডিপি নামা শ্যামপুর বস্তিতে তিনটি হ্যান্ডওয়াশ স্টেশন স্থাপন করেছিল; সেখানকার মানুষদের মাঝে সাবান ও ডিটারজেন্ট পাউডার বিতরণ করেছিল এবং বস্তির প্রায় ১০০০ বাড়িতে মাস্ক পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ব্রাক ইউডিপি এর পক্ষ থেকে ৩০ জন বাচ্চার মাঝে স্কুল ব্যাগ এবং খাতা-কলম প্রদান করা হয়েছিল।

বর্তমানে আমি ARISE এর কমিউনিটি গবেষক এবং ব্র্যাক ইউডিপির কমিউনিটি অর্গানাইজার হিসাবে নিজ এলাকায় কাজ করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনে এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের মধ্যে করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং সচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করা থেকে শুরু করে সেই কার্যকলাপগুলো বাস্তবায়ন হওয়া পর্যন্ত জড়িত ছিলাম। লকডাউনের মধ্যে এলাকার মানুষদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রতি মাসেই আমাকে একাধিক মিটিং এর আয়োজন করতে হয়েছিল। মিটিংগুলোতে আমি করোনা প্রতিরোধে মাস্কের ভূমিকা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে বুঝিয়ে বলেছিলাম। পাশাপাশি যথাযথ নিয়মে হাত ধোয়ার পদ্ধতিগুলো প্রদর্শন করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এ কাজগুলো করার সময় একজন নারী হিসেবে এবং মাঠকর্মী হিসাবে আমাকে নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এবারের লকডাউনে যখন এলাকার মানুষদের মাঝে মাস্ক বিতরণে করছিলাম, তখন অনেকেই খারাপ আচরণ করেছিল। তারা বলেছিল, “পেটে ভাত নাই, মাস্ক পরে কি হবে?” গতবারের লকডাউনে এলাকার অনেকেই আর্থিক অনুদান পেয়েছিল; খাদ্য সহায়তা পেয়েছিল। কিন্তু যখন তারা দেখল এবারের লকডাউনে আমরা শুধুমাত্র মাস্ক দিচ্ছি, তখন তারা বিনামূল্যে দেওয়া মাস্কগুলো নিতে চাইত না বরং মাস্ক নিতে অস্বীকৃতি জানাত এবং আমাদের কাজের সমালোচনা করত। যখন আমরা তাদের মাস্ক পড়ার কথা বলতাম, তারা বলত, “আমাদের করোনা হবে না।” যখন তাদের বাইরে যেতে বারণ করতাম, তারা বলত, “বাইরে না গেলে কাজ করব কিভাবে? আমরা খাব কি?” এরকম পরিস্থিতিতে এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে সাহায্য করেছে। যেমন আমি তাদের সমস্যা বা অভিযোগগুলো প্রথমে শুনেছি এবং মাস্ক পরলে বা বাড়িতে থাকলে তাদের কি সুবিধা হবে, ফ্রি মাস্ক কিভাবে তাদের অর্থ সাশ্রয়ে সাহায্য করবে-সেসব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি।

ধলপুর

জুম্মন ধলপুর বস্তিতে বসবাসরত একজন কমিউনিটি গবেষক এবং সে এলাকাভিত্তিক যুব সংঘ “ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েটস” এর বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত।

বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনার সংক্রমণ শুরু হয় তখন মাস্ক পরার জন্য মানুষকে সচেতন হলেও, ২০২০ সালের শেষের দিকে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে যাওয়াতে বস্তির অনেক মানুষই বর্তমানে মাস্ক ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করতে শুরু করে। এছাড়া দ্বিতীয় লকডাউনের সময় ধলপুর বস্তিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম খুবই সীমিত ছিল। একারণে ক্লাবের সদস্যরা নিজ উদ্যোগে এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলেছিল — তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য মাস্ক পরতে উৎসাহিত করেছিল। লকডাউনের সময় ARISE এর কমিউনিটি গবেষক হিসেবে আমি নিজেই জীবাণুনাশক (ব্লিচিং পাউডার) কিনে এলাকার বিভিন্ন অলিতে গলিতে স্প্রে করেছিলাম। “ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েটস” ক্লাবের সদস্যরাও এলাকা জীবাণুমুক্ত করার জন্য এ জাতীয় পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতামূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল।

কাজ করার সময় এলাকার অধিকাংশ মানুষ উৎসাহ দিলেও, অনেকই আমাদের কাজের উদ্দেশ্যে বুঝতে না পেরে আমাদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করত। যেমন, আমি যখন স্প্রে করছিলাম, একজন বলেছিল “এরা এইসব কাজ লোক দেখানোর জন্য করে,” আরেকজন বলেছিল, “টাকা পায় দেখে এইসব কাজ করে।” এই সমস্যা সমাধানের জন্য এলাকার মানুষদের স্প্রে কেন করা হচ্ছে, স্প্রে করলে কি কি উপকার হবে — এই বিষয়গুলো আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম। এছাড়াও, আমাদের এলাকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করার সময় আমরা, কমিউনিটি গবেষকরা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাতে চেষ্টা করেছি। এই পদ্ধতিগুলো এলাকার মানুষদের আস্থা অর্জনে আমাদের সহায়তা করেছিল।

কল্যাণপুর পোড়াবস্তি

বিল্লাল কল্যাণপুর পোড়াবস্তির একজন তরুণ সমাজকর্মী, যিনি ARISE বাংলাদেশের একজন কমিউনিটি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি এবং তার এলাকায় অবস্থিত “প্রতিমঞ্চ” নামক ক্লাবটি মহামারীর শুরু থেকেই বস্তিতে কোভিড-১৯ সচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে।

ধলপুর বা শ্যামপুর বস্তিতে আর্থিক অনুদান বা খাদ্য সহযোগিতা না পৌঁছালেও, কল্যাণপুর পোড়াবস্তির চিত্র এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানে দীর্ঘ ১০ মাস ধরে World Food Programme ব্র্যাকের সহায়তায় প্রায় ১৭০০ পরিবারকে বিকাশের মাধ্যমে ৩০০০ টাকার আর্থিক অনুদান দিয়ে আসছে এবং এই কার্যক্রম দ্বিতীয় লকডাউনের সময়ও অব্যাহত ছিল। এবারের লকডাউনের সময় এলাকার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি একদিন রাত দশটার পর খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে ত্রাণ (২.৫ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, ১/২ কেজি পেঁয়াজ, ১ কেজি আলু, ১ কেজি মিষ্টি কুমড়া, ১/২ কেজি মসুর ডাল) বিতরণ করেছিলেন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তুলনায় এই সাহায্য একেবারেই নগণ্য ছিল এবং সেদিন যেসব লোকজন সাহায্য পেয়েছিল তাদের অধিকাংশই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পূর্ব পরিচিত ছিল। কিছুদিন পর আরেকটি প্রতিষ্ঠান খাদ্য সহযোগিতা করেছিল, কিন্তু দুর্নীতি ও অসম বন্টনের কারণে সেই বারও এলাকার হাতেগোনা কিছু মানুষ সাহায্য পেয়েছিল।

আমরা, কমিউনিটি গবেষকরা, এবং এই ক্লাবের সদস্যরা দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের সময় জনসচেতনতা বাড়াতে এলাকায় মাইকিং করেছিলাম, পোস্টার এবং লিফলেট বিতরণ করেছিলাম। ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের অর্থায়নে কাজগুলো করেছিল। এছাড়া আইইডি নামক একটি এনজিও করোনার উপর বস্তিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য যখন যোগাযোগ করেছিল, তখন আমি এলাকার মানুষদের সাথে নিয়ে একটি র‍্যালির আয়োজন করেছিলাম। লকডাউনের সময় বস্তির বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি যেয়ে আমি করোনা মোকাবেলায় সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা, কারো হাঁচি-কাশি, জ্বর হলে কি করণীয়- সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি্লাম এবং এই কাজগুলো করার পাশাপাশি, বাড়ির বাইরে বের হলে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছিলাম।

ARISE বাংলাদেশের কমিউনিটি গবেষকরা- যারা বস্তিতে বসবাসকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতাসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়- তারাই মূলত নিজেদের এলাকায় পরিবর্তনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কির একটি বিখ্যাত উক্তি আছে,

যে উন্নয়ন কিংবা পরিবর্তনে উপর তালার মানুষদের খুব কমই অবদান থাকে, পরিবর্তনগুলো আসে নিচু তলার মানুষের সংগ্রাম থেকে।”

ARISE বাংলাদেশের কমিউনিটি গবেষকরা বস্তি এলাকার ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করার মাধ্যমে তথাকথিত এই নিচু তলার মানুষদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে।

ARISE বাংলাদেশ ২০১৯ সাল থেকে ঢাকা শহরের ৩ টি নিম্ন আয়ের ঘনবসতিতে (যা বস্তি নামেও পরিচিত) বসবাসরত মানুষদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অংশগ্রহণমূলক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এলাকা ৩ টি হল: ধলপুর, নামা শ্যামপুর ও কল্যাণপুর পোড়াবস্তি। এই ব্লগটিতে, ARISE বাংলাদেশের তিনটি গবেষণা এলাকার তিনজন কমিউনিটি গবেষক নিশিকা সমদ্দার টুম্পা, জীবন আহম্মেদ জুম্মন, বিল্লাল হোসেন জুয়েল দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এবং ARISE বাংলাদেশের গবেষক আফসানা ইয়েমিন এই ব্লগটি লেখার ক্ষেত্রে তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছে।

--

--

BRAC James P Grant School of Public Health

BRAC JPG School of Public Health, Bangladesh tackles global health challenges affecting disadvantaged communities through Education Training Research & Advocacy