যখন কর্মক্ষেত্রে নারী তখন গৃহস্থালীর কাজ কার? বাংলাদেশের কিশোর ও তরুনদের ভাবনা

লেখক: আব্দুল জব্বার তপু

ছবি: লেখক

বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো,

সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে

প্রবাদটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়। কারণ প্রবাদটিতে সংসারের অশান্তির জন্য পরোক্ষভাবে নারীকেই দায়ী করা হয়েছে। ইদানিং বেশ কিছু কবি-সাহিত্যিকদের এর পরে আরো একটি লাইন ব্যবহার করতে দেখা যায়। তা হলো,

গুনবানপতি যদি থাকে তার সনে

সত্যিই তো সংসারতো শুধু রমনীর নয় বরং পতি ও রমনী দুজনেরই। অর্থাৎ সংসারে সুখ বলি বা অশান্তি বলি উভয়েরই জন্য নারী পুরুষ উভয়ই এর অংশীদার বা দায়ী। তবে এই লাইনটি বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। কারণ চিরায়িত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা নিজেদের স্বার্থে আঘাত করে এমন কিছু প্রচার করবে কেন!

চিরায়িত প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা আয় উপার্জন করে পরিবারের সদস্যদের খাবার, পোশাক-আশাকসহ যাবতীয় ভরণ পোষনের ব্যবস্থা করবে আর নারীরা ঘরের কাজ করবে, বাচ্চা লালন-পালন করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষায় বা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সাথে নারীর অংশগ্রহণ এই ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারী বেসরকারী প্রায় সকল অফিস আদালতে নারীকে পুরুষের সাথে কাজ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের উত্থানের পর থেকে নারীর ক্ষমতায়ন ধারণা পরিবর্তন হওয়া শুরু করে। পঞ্চম শ্রেণী বা অষ্টম শ্রেণী থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত নারীরা শহরের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী কল কারখানায় কাজ করে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের সরকারী-বেসরকারী কর্মক্ষেত্রে নারীর অংগ্রহণের হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। যা ২০০০ সালে ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন ও জঁ দ্রজ তাঁদের “ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা” (২০১৫ সালে প্রকাশিত) বইয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের নারীদের অগ্রগতি তুলনা করতে গিয়ে লেখেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি বেশি। বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। যেখানে ভারতে ২৯ শতাংশ। স্বল্প শিক্ষিত বা অক্ষর জ্ঞান না থাকা নারী, যারা অফিস-আদালতে চাকুরি পায় না তারাও বাসা বাড়িতে কাজ করে আয় করে থাকে। নারীরা পুরুষের মত আয় করে পরিবারের আর্থিক যোগান দেয়। পিছিয়ে নেই গ্রামের মেয়েরাও। তারা শিক্ষকতা, ক্ষুদ্র ব্যবসা (মুদি দোকান, কাপড়ের ব্যবসা প্রভৃতি), সেলাই, স্বাস্থ্যকর্মী বা গৃহস্থালীতে পশু-পাখি পালনের মত আর্থিক কাজের সাথে যুক্ত।

কর্মক্ষেত্রে নারীর এই ব্যাপক অংশগ্রহণের পর প্রশ্ন উঠেছে গৃহস্থালীর কাজগুলো কার? নারীর না পুরুষের নাকি উভয়ের? এ নিয়ে কি ভাবেন এদেশের কিশোর-তরুনরা?

ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের কিশোর ও যুবকদের (১৫-২৪ বছর বয়সী) যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণার প্রথম ধাপে ৬৪ টি জেলার ৩৭০ টি গ্রাম/ওয়ার্ড থেকে ১১০১২ জন কিশোর ও তরুণের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। যাদের মধ্যে প্রায় ৮১ শতাংশই কমপক্ষে পঞ্চম শ্রেণী পাস ও প্রায় ২৯ শতাংশ কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস। এই গবেষণার প্রশ্নপত্রে “গৃহস্থালীর কাজ ও নিত্যকর্ম ” বিষয়ক একটি স্কেল ব্যবহার করে প্রত্যেকের কাছে গৃহস্থালীর কাজ নিয়ে পাঁচটি বক্তব্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে সে সম্পর্কিত মতামত জানতে চাওয়া হয়। স্কেলে অসম্মত, সম্মতও না অসম্মতও না এবং সম্মত এই তিনটি অপশন রাখা হয়।

স্কেলের প্রথম বক্তব্য ছিল, “বাচ্চা খাওয়া-দাওয়া করানো, প্রশ্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করা এবং গোসল করানো মায়ের দায়িত্ব” ও দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল “বাড়ি ও পরিবার দেখা-শোনা করা নারীর কাজ” । এখানে বাড়ি ও পরিবার দেখা-শোনা বলতে বাড়ির যাবতীয় কর্মকান্ড দেখা-শোনা ও পরিবারের সকল সদস্যদের ভাল-মন্দ, অসুখ-বিসুখ, পোশাক-আসাক প্রভৃতির দেখা-শোনাকে বোঝানো হয়েছে।

প্রথম বক্তব্যটিতে প্রায় ৫৮% সম্মত, ১৫ % সম্মতও নয় অসম্মতও নয় এবং ২৭% অসম্মত মতামত দেন। দ্বিতীয় বক্তব্যটিতে ৫৬% কিশোর ও তরুন সম্মত, ১৯% সম্মতও নয় অসম্মতও নয়, ২৫% অসম্মত মতামত দেন।

এখানে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ কিশোর ও তরুনরাই উপরোক্ত দুটি বক্তব্যে সম্মতি জানিয়েছেন। যার অর্থ হলে তারা মনে করে বাচ্চা লালন-পালন, গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সার্বিক বিষয় দেখ-ভালের দ্বায়িত্ব নারীদের। প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কোন মতামতই দেননি। বাকিরা বক্তব্যগুলোর সাথে অসম্মতি জানিয়েছেন। যার অর্থ তারা মনে করেন বাচ্চা লালন-পালন ও গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ শুধু নারীদেরই নয় বরং নারী-পুরুষ উভয়েরই।

একই গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে গুনগত মান যাচাই করার জন্য দেশের চারটি জেলায় অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে এক মাস ব্যাপী গবেষণা করা হয়। গবেষণায় গবেষকরা চারটি জেলার নির্দিষ্ট তিনটি গ্রাম ও একটি ওয়ার্ডে এক মাস থেকে প্রতিটি স্থান থেকে ১০ জন করে ৪০ জন কিশোর ও যুবককের সার্বিক স্বাস্থ্যগত আচরণ পর্যবেক্ষন করেন। তাদের সাথে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাবে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই গবেষণায়ও গৃহস্থালীর কাজ নিয়ে কিশোর ও যুবকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়।

এই ৪০ জনের মধ্যে ১০ জন ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আর বাকি ৩০ জন বাঙ্গালী কিশোর ও যুবক ছিল। ক্ষৃদ্র নৃ গোষ্ঠীর অধিকাংশেরই মতামত হলো, গৃহস্থালীর কাজগুলো নারী-পুরুষ উভয়ই করতে পারে। তবে কাজগুলো নারীদের। গবেষণা এলাকায় নারী পুরুষ উভয়কেই গৃহস্থালীর কাজ দেখা গেছে। বাঙ্গালীদের মধ্যে অধিকাংশই মতামত দেন যে, গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ নারীদের। তা সে কর্মজীবীই হোক আর গৃহিণীই হোক। কারণ হিসেবে তারা বলেন, তারা সারাজীবন নারীদেরই গৃহস্থালীর কাজ করতে দেখেছেন তাই এটা তাদেরই কাজ তাই তারাই করে। ২৩ বছর বয়সী নবম শ্রেণী পাশ একজন সিএনজি চালক তরুন যার স্ত্রী একজন কর্মজীবী নারী, তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আপনি ও আপনার স্ত্রী কাজ থেকে ফিরে কি করেন? তিনি বলেন,

“আমি, আমি কাজ থেকে এসে কি কিছুই করিনা।…সে (তার স্ত্রী) এসে রান্না-বান্না করে”

তবে তাদের কেউ কেউ বলেন, গৃহস্থালীর কাজে নারীদেরকে পুরুষের ‘সাহায্য’ করতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে যখন নারীরা রান্না করে তখন পুরুষের উচিৎ বাচ্চাকে দেখাশোনা করা, নারীরা অসুস্থ থাকলে রান্নার কাজটা পুরুষের করা উচিৎ।

আবার বেশ কিছু কিশোর ও যুবক বলেন, কোন পুরুষ যদি গৃহস্থালীর কাজ করে তাহলে পরিবারের বা সমাজের লোকেরা তাকে মেয়ে মানুষ, বৌ পাগল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রভৃতি বলে ভৎর্সনা করে। গবেষণা এলাকাগুলোতে ঘোরাঘুরির সময় বান্দরবান ছাড়া বাকি তিনটি এলাকাতেই প্রায় শতভাগ বাড়ির গৃহস্থালীর কাজ নারীদের করতে দেখা যায়। ১৭ বছর বয়সী অবিবাহিত একজন কিশোর গৃহস্থালীতে কাজ করে এমন পুরুষদের সম্পর্কে বলেন,

“ওরা বেইট্টা মানে মাউগা মানে মেয়ের মত ছলে (চলে)”

ইদানিং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে আসা প্রগতিশীল মানসিকতার পুরুষরা নিজেদেরকে নারীর প্রতি সহানুভতি দেখানোর জন্য বলে থাকেন যে, আমি তো ঘরের কাজে আমার স্ত্রীকে ‘সাহায্য’ করি, রান্নার কাজে ‘সহযোগিতা’ করি, মাঝে মাঝে বাচ্চাকে দেখাশুনাও করি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলেই কি এটা ‘সাহায্য’ বা ‘সহযোগিতা’? তাহলে কি কর্মজীবী নারীরা প্রতিনিয়ত পুরুষকে সাহায্য করছে? পুরুষরা কি এটা মেনে নেবে? একজন পুরুষ তার নিজের ঘরের কাজ করবে এটাই তো সাভাবিক। এখানে ‘সাহায্য’ বা ‘সহযোগিতা’র প্রশ্ন কেন আসবে? শব্দের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘সাহায্য’ বা ‘সহযোগিতা’ শব্দগুলো আমাদের সম্পর্কগুলোকে জটিল করে তোলে। এই শব্দগুলোর সাথে অনাবশ্যক অপশন চলে আসে। এই ধরণের শব্দগুলো একে অপরের মধ্যে বিদ্যমান সম্মান নষ্ট করে।

যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিরোধী দলীয় নেতা, শিক্ষামন্ত্রীসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নারীদের অবস্থান সে দেশের শিক্ষিত কিশোর ও যুবকদের অধিকাংশেরই গৃহস্থালীর কাজ এই ভাবনা সত্যিই ভাববার বিষয়। যে হারে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে গৃহস্থালীর কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ কি সেই হারে বাড়ছে? তার একশত ভাগের দশ ভাগও কি বাড়ছে? নাকি নারী তার পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিজেকে মেশিন করে তুলেছে। যে কিনা একাধারে একজন কর্মজীবী ও গৃহিনী। যাদের দিন শুরু হচ্ছে ভোর চারটায় আর শেষ হচ্ছে রাত বারোটায়। কারণ তাকে কর্মক্ষেত্রে কাজের পাশাপাশি তাকে সম্পূর্ণ ঘরের কাজও করতে হচ্ছে। এগুলো নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। হাজার বছর ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে মানসিক নির্মান তা ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। যে কিশোর ও তরুনরা আগামীর দেশ গড়ার কারিগর হবে তাদের কাছে সঠিক বার্তা পৌছে দিতে হবে যে কর্মজীবী নারীরা মেশিন না মানুষ, কাজের কোন নারী-পুরুষ নেই, সবগুলো কাজই সবাই করতে পারে আর কর্মজীবী নারীদের সাথে পুরুষকে বাড়ির কাজ গুলো ভাগ করে নিতে হবে। এই বার্তা বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে। যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করে, সভা-সমাবেশ করে, লেখালেখির মাধ্যমে বা টিভি টক-শো করে। তবেই নারী-পুরুষের সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আব্দুল জব্বার তপু, এ্যাসিসটেন্ট প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, ব্র্যাক-জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

--

--

BRAC James P Grant School of Public Health

BRAC JPG School of Public Health, Bangladesh tackles global health challenges affecting disadvantaged communities through Education Training Research & Advocacy