‘স্বাভাবিক’ অথবা ‘নতুন স্বাভাবিক’: করোনাকালীন সময়ে শহরের বস্তিগুলোর জনজীবন

By এশা আক্তার লাবন্য, সুইটি আক্তার, মোঃ তানভির ইসলাম, মোঃ ইমরান হোসেন মিঠু

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত BRAC James P Grant School of Public Health (JPGSPH) ২০১৯ সাল থেকে ARISE প্রজেক্টের নামে ঢাকা শহরের ৩ টি নিম্নআয়ের ঘনবসতিতে (কল্যাণপুর পোড়াবস্তি, ধলপুর এবং নামা শ্যামপুর) বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থ থাকা সম্পর্কে জানার জন্য অংশগ্রহণমূলক গবেষণা করছে। এই গবেষণার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গবেষণা প্রকল্পে এলাকার মানুষের গবেষণাকাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা এই গবেষণায় কমিউনিটি গবেষক হিসেবে কাজ করছি।

করোনা মহামারী বিগত এক বছর ধরে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তকে গ্রাস করে বেড়াচ্ছে তার রূপের নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, বিগত এক বছর ধরে বিভিন্ন সময় করোনা মহামারী এদেশে বিভিন্ন রূপ ধারন করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার দেশব্যাপী লকডাউন সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই বছরের (২০২১) মার্চের মাঝামাঝি থেকে আবারো বাংলাদেশে করোনার ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়েছে যাকে করোনার দ্বিতীয় ডেউ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই করোনার দ্বিতীয় ডেউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পুনরায় ৭ এপ্রিল থেকে ৩০ মে ২০২১ পর্যন্ত দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে। এর ফলে আবারও বিপাকে পরে ঢাকার শহরের বস্তিগুলোর দৈনিক শ্রমজীবী সহ খেটে-খাওয়া মানুষজন।

বস্তিগুলোতে করোনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

ঢাকার শহরের বস্তিগুলোতে জনসংখ্যা ঘনত্ব শহরের অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি। ফলে একই রান্নাঘর ও পানির উৎস অনেকে মিলে ব্যবহার করতে হয়, এবং ছোট এক ঘরে একই পরিবারের সবাই মিলে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়। এছাড়া একই টয়লেট ও গোসলখানা এক সাথে ১০ থেকে ১৫ টি পরিবার , কোনক্ষেত্রে ৬০ টি পরিবারও ব্যবহার করে থাকে। এই বিষয়গুলো সেখানে করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে কাজ করে। যদিও ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকার যখন সারাদেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে প্রথমবার লকডাউন ঘোষণা করে, তখন ঢাকার শহরের বস্তিগুলোতে করোনার বিস্তার ঠেকাতে স্থানীয় ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে এবার ২০২১ সালের মার্চ মাসে দেশব্যাপী দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন ঘোষণা করার পরবর্তী সময়ে সারাদেশের বস্তিগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও করোনা প্রতিরোধ এর ক্ষেত্রে স্থানীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের তেমন কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ডেউতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত, তখন শহরের বস্তিগুলোর মানুষজনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের নতুন প্রজাতির ভয়াবহতা নিয়ে তেমন কোন সচেতনতা নেই বললেই চলে।

তাদের অনেকেরই মতে যারা সমাজের উচ্চবিত্ত, কম কায়িক পরিশ্রম করে করোনা শুধু তাদেরকেই আক্রান্ত করে। বস্তির খেটে খাওয়া গরীব মানুষেরা করোনায় আক্রান্ত হয়না। এই সম্পর্কে নামা শ্যামপুরের একজন রিক্সাচালক বললেন, “করোনা হইল বড়লোকের রোগ, গরীব যারা খাইটা খায় তাগোর করোনা হয়না।” সচেতনতার অভাবে বস্তিগুলোতে বসবাসকারী খেটে খাওয়া লোকজন কোন প্রকার স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যেখানে সেখানে চলাফেরা করছে, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে, বাজারে ভিড় করছে, এমন একটা পরিস্থিতি যেন দেশে করোনা বলে কিছু নেই। বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি যেমনঃ মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রতি বস্তিবাসীর অনীহা, এবং বস্তির মত অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস- বস্তিবাসীকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

লকডাউন মেনে চলা যেন বিলাসিতা

বর্তমানে ঢাকা শহরের বস্তিগুলোর খেটে খাওয়া মানুষেরা করোনার কারনে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বস্তিগুলোতে যারা বসবাস করে তাদের সিংহভাগই অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতের (গৃহকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর) সাথে জড়িত। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার ফলে বস্তিগুলোর বেশিরভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে বা আয় অনেক কমে গিয়েছে। এর ফলে তাদের অভাবে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে তাদের জমানো অর্থ খরচ করে, নিজ সম্পত্তি বিক্রি করে, অথবা ঋণ করে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনাহারের সাগরে নিমজ্জিত দিন আনে দিন খায় এমন বস্তিবাসীর নিকট করোনার ভয়ের চেয়ে পেটের ক্ষুধার ভয় বেশি। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় জীবিকার তাগিদে তারা লকডাউন উপেক্ষা করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে, জীবিকার সন্ধানে দিকবেদিক ছোটাছুটি করছে। যদিও প্রথম লকডাউনে দরিদ্র বস্তিবাসীর সাহায্যার্থে সরকার, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও), সমাজের উচু/ বিত্তবান শ্রেণীর মানুষজন বিভিন্ন আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কেউই বস্তিবাসীর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। যার ফলে যদিও প্রথম পর্যায়ের লকডাউনে সাহায্য সহায়তা পেয়ে দরিদ্র মানুষজন কোনভাবে বেঁচে থাকতে পারলেও দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনে কোন সহায়তা না পেয়ে তাদের জন্য পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

বস্তিবাসীর মতে যেখানে বস্তির দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাঁদের দৈনিক দুবেলার খাবার যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে তাদের জন্য লকডাউন মানা বিলাসিতা ব্যতীত কিছু নয়। ধলপুর বস্তির একজন বাসিন্দা কে লকডাউন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন “ঘরে চাল নেই, করোনায় আর কি হবে !”

‘নতুন স্বাভাবিক’?

এখন অনেকেই বলছেন করোনাকে নিয়েই আমাদের নতুন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে। কিন্তু কোনটি ‘স্বাভাবিক’ আর কোনটিই বা ‘নতুন স্বাভাবিক’? সবার জন্যই কি জীবন যাপনের নতুন স্বাভাবিকের সাথে মানিয়ে নেয়া সম্ভব? যেখানে আমরা ঢাকার শহরের হাজার হাজার বস্তিবাসী সরকারের কোন সাহায্য ছাড়াই এই পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। সেখানে আমাদের জন্যও কি সমাজের অন্যদের মত জীবন যাপনের নতুন স্বাভাবিক একই? আমরা কি না খেয়ে মারা গেলেও সরকারের জারি করা লকডাউনে ঘরে বসে থাকব? নাকি আমরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও আমাদের প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করতে লকডাউনের মধ্যেও বাইরে বের হব?

এই ব্লগটিতে, ARISE বাংলাদেশের তিনটি গবেষণা এলাকার তিনজন কমিউনিটি গবেষক এশা আক্তার লাবন্য, সুইটি আক্তার, মোঃ তানভির ইসলাম করোনাকালীন দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনে তাদের এলাকার জনজীবন পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন এবং ARISE বাংলাদেশের গবেষক মোঃ ইমরান হোসেন মিঠু এই ব্লগটি লেখার ক্ষেত্রে তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছে।

--

--

BRAC James P Grant School of Public Health

BRAC JPG School of Public Health, Bangladesh tackles global health challenges affecting disadvantaged communities through Education Training Research & Advocacy